পরাধীন ভারতে মেদিনীপুরের একটি ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচ | A historical football match played by Balichak Club during British regime.

পরাধীন ভারতে মেদিনীপুরের একটি ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচ।

A historical football match played by Balichak Club during British regime.

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা।


১৯৪৭ সালের ১৫-ই অগাস্ট। আগের দিন মধ্যরাতে স্বাধীন হল আমাদের দেশ ― সুজলা সুফলা ভারতবর্ষ। প্রায় দু'শ বছরের গোলামীর সমাপ্তি। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক রক্তক্ষয়ী উজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। সেই অসমাপ্ত ইতিহাসের পাতায় চিরভাস্বর হয়ে আছে একটি ফুটবল ম্যাচ। না, ১৯১১ সালে সংঘটিত আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব বনাম ইষ্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট-এর খেলা নয়। বীর ভূমি অখণ্ড মেদিনীপুরের ডেবরা থানার অন্তর্ভুক্ত বালিচক এলাকায় সংঘটিত একটি ফুটবল প্রতিযোগিতার কাহিনী উপস্থাপন করব এখানে। সেদিন এগারোজন খেলোয়াড়-যোদ্ধার সদর্প পদচারণা কেবলমাত্র খেলার মাঠের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাদের বিজয়-উল্লাস পবিত্র মেদিনীপুরের মাটি সমৃদ্ধ করেছিল।

পরাধীন ভারতে মেদিনীপুরের একটি ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচ | A historical football match played by Balichak Club during British regime.
'বালিচক ক্লাব রুরাল লাইব্রেরী' -র উল্টোদিকের এই ঘরটিই 'বালিচক ক্লাব'।

সালটা ছিল ১৯৩৮। সে-বছর ১৮-ই জানুয়ারি হরিপুরা কংগ্রেসে কংগ্রেস-সভাপতি হিসাবে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা করেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির তদানীন্তন জেনারেল সেক্রেটারি জে বি কৃপালনী। সুভাষচন্দ্রের মনোনয়নে আনন্দে উল্লসিত গোটা ভারতবর্ষ। কারণ ততদিনে ভারতবাসী বুঝে গেছে অহিংস নয়, সহিংস পথে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধিলাভ সম্ভব। আর সহিংস আন্দোলনের যোগ্য নেতা প্রিয় নেতাজী। এর ব্যতিক্রম ছিল না সোনার বাংলা। বাংলাদেশের বিপ্লবীরা সেদিন সুভাষচন্দ্রের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বিগুন উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের অভিপ্রায়ে।

এ হেন আন্দোলনের তীব্র ঢেউ আছড়ে পড়ল অখ্যাত বালিচকের বুকে। রাজনৈতিক তথা বিপ্লবী বন্দিদের আর্থিক অনটন দূর করার জন্য একটি লিমিটেড কোম্পানি খোলা হয়। ২৬-শে জুলাই। সুভাষচন্দ্রের নামানুসারে নাম রাখা হয় 'দেশগৌরব কটন মিল'। অবশ্যই রেজিস্ট্রেশন করে। মধ্যস্থতা করেন বলাইচন্দ্র হাজরা, বীরেন্দ্র কুমার ঘোষ, বিভূতিভূষণ হুই এবং বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স-এর প্রথম সারির নেতৃবর্গ। উক্ত শিল্পকর্মসূচির প্রস্তাবিত স্থান নির্দিষ্ট হয় মেদিনীপুর জেলার মধ্যে রূপনারায়ন নদীর তীরে। কিন্তু কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচার ব্যাপারে নিরুৎসাহ সাধারণ মানুষজন। ইংরেজ শাষকের ভয় ও অত্যাচার তার কারণ। ফলস্বরূপ কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ রইল এ হেন কোম্পানির কাজকর্ম। বিফলে গেল সব প্রচেষ্টা।

পরাধীন ভারতে মেদিনীপুরের একটি ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচ | A historical football match played by Balichak Club during British regime.
বালিচক ক্লাব।

এদিকে ডেবরা থানার যুবসমাজ সহিংস আন্দোলনে ঝুঁকে পড়তে পারে এমন অশনিসংকেত বুঝতে পেরে তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বি. আর. সেন দাবার চাল পাল্টে দিলেন। জেলার বিভিন্ন জায়গায় ক্লাব, লাইব্রেরি, প্রমোদভবন প্রভৃতি নির্মাণে যুবসমাজকে উৎসাহিত করা মূল লক্ষ্য হয়ে যায় শাষকের। তারই অবশ্যম্ভাবী ফসল বালিচকে 'করোনেশন ক্লাব' প্রতিষ্ঠার তীব্র প্রচেষ্টা। অবশ্যই স্থানীয় জনগণের অর্জিত টাকায়। বালিচকের জনগণের টাকায় হবে ক্লাব; অথচ তার নামকরণে থাকবে না 'বালিচক'-এর নাম। তাই গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার এমন অভিনব প্রয়াস রুখে দিলেন সংগ্রামীরা। কীভাবে ?

বালিচকের ভূমিপুত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী বলাইচন্দ্র হাজরা প্রায় একক প্রচেষ্টায় সরকারের প্রস্তাব মান্য করতে সম্মত হলেন না। তার অনড় যুক্তি ― ক্লাবের নাম রাখতে হবে 'বালিচক ক্লাব'। কর্তৃপক্ষ এমন আজব প্রস্তাব পাত্তা দিল না। বরং ভেতরে ভেতরে এলাকার বিশিষ্ঠ বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গকে স্বেচ্ছায় ও অনিচ্ছায় ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে দিলেন। ডেবরা থানার বর্ধিষ্ণু জমিদার গোপালপুরের আশুতোষ মাইতির সম্মতি নিয়ে তার পিতা স্বর্গীয় নন্দলাল মাইতি মহাশয়ের স্মৃতিনামাঙ্কিত সুদৃশ্য বিজয় ট্রফি সহযোগে একটি ফুটবল লিগের আয়োজন করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ব-কলমে সরকার। সেই লিগে খেলার সব নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে করোনেশন ক্লাব 'A' ও 'B' নামে দুটি টিম খেলায়। যা সম্পূর্ণ নিয়মবিরুদ্ধ। প্রতিবাদ নয়, রাগে গরগর করে সাধারণ মানুষ, বিশেষত যুব সম্প্রদায়। উচিত শিক্ষা দেবার সুযোগের অপেক্ষায় দিন গোনে সকলে।

পরাধীন ভারতে মেদিনীপুরের একটি ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচ | A historical football match played by Balichak Club during British regime.
'বালিচক ক্লাব রুরাল লাইব্রেরী' -র উল্টোদিকের এই ঘরটিই 'বালিচক ক্লাব'।

এমন এক সন্ধিক্ষণে বলাইবাবু 'বালিচক ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশন' নাম দিয়ে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এবং ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আরও অনেক দল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেও খেলার মুখ্য আকর্ষণ মূলত একটি খেলা ― করোনেশন ক্লাব বনাম বালিচক ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশন। করোনেশন ক্লাব 'A' টিম নাম দিয়ে ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে প্রথম খেলায় অংশগ্রহণ করে। তুমুল হাততালির সঙ্গে শুরু হয় খেলা। স্বাভাবিক ভাবেই খেলায় পরাজিত করোনেশন 'A' টিম। তারপর ? বিজয়ী দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে মাঠের মধ্যে চরম অভদ্রতা ও সীমাহীন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পরাজিত দলটি। এর ফলে অবশ্য সুবিধা হয় বালিচক বিজয়ী দলটির। বিত্তবান মানুষজন এবার সামান্য দ্বিধাগ্রস্থ। এর মধ্যে অনেকে শাষকের শিবির ছেড়ে ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সমর্থনে উদ্যোগী। কারণ এর পরের খেলা বালিচক ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশন ভার্সাস বন্ধ ঘরে অন্যায়ভাবে তালিকাভুক্ত করা করোনেশন 'B' টিম। স্বাধীনচেতা আশুতোষ মাইতি মহাশয় এবার ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশনকে অর্থ সাহায্য করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আরও শক্তিশালী দল গঠন আশু প্রয়োজন।

নির্দিষ্ট দিনে টানটান উত্তেজনায় শুরু হয় খেলা। দূর দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষের স্রোত ভেঙে পড়ে খেলা দেখতে। তুমুল হর্ষধ্বনিতে এবারও শোচনীয় পরাজয় স্বীকার করে করোনেশন ক্লাবের 'B' টিম। মুখ পোড়ে কর্তৃপক্ষের। তাদের টনক নড়ল। শুভবুদ্ধির উদয় হয়। বালিচক ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সংঘাত মেটাতে নির্দেশ দেয় উর্ধতন কর্তৃপক্ষ। অন্যথায় করোনেশন ক্লাবের স্থায়ী গৃহ নির্মাণের পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। সে-মোতাবেক এস ডি ও'র ওপর ভার পড়ে সংঘর্ষ নিস্পত্তির। তিনি একটি সভা আহ্বান করেন বালিচক ভজহরি বিদ্যালয়ে। সভায় সার্কেল ইন্সপেক্টর অমুল্য মুখার্জি বেশ কিছু আপত্তিকর প্রস্তাব উত্থাপন করলেও বলাইবাবু অনড় ― 'বালিচকের জনগণের টাকায় প্রস্তাবিত যে-কোন প্রতিষ্ঠানের নামকরণে 'বালিচক' নাম রাখতে হবে, অন্য নাম থাকবে না। অন্য নাম থাকলে সাধারণ জনগণের থেকে অর্থ সাহায্য নেওয়া যাবে না। অন্যথায় সরকার নিজের টাকায় ক্লাবের গৃহ নির্মাণ করুক। সেক্ষেত্রে কারও অভিযোগ থাকবে না।' শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে বাধ্য হয় সরকার পক্ষ। সরকারি কোষাগার থেকে প্রাপ্ত অর্থে ক্লাবঘর নির্মাণ সম্পন্ন হয়।

শুধু তাই নয়, প্রিয় পাঠক, পরবর্তী কালে কর্তৃপক্ষ করোনেশন ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে 'X.Y.Z.' রাখে ও ওই নামে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। শাষকের এ হেন পরাজয়ে সেদিন অকাল আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছিল বালিচক-সহ পুরো ডেবরা থানা। সেদিনের সেই ক্লাব আজকের 'বালিচক ক্লাব' নামে পরিচিত। ক্লাব সংলগ্ন একটি লাইব্রেরি আজও সুদীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলছে।


midnapore.in

(Published on 31.08.2020)

■ তথ্যঋনঃ

● ডেবরা থানার ইতিকথা - বলাইচন্দ্র হাজরা।

● অতীতের স্মৃতির পাতা থেকে - আনন্দময়ী হাজরা।


■ কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

নিত্য দত্ত, বালিচক বালিভূমি।

সাহিত্য গোষ্ঠী, বালিচক, ডেবরা।